এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান: উত্তরা বিমান দুর্ঘটনার বিশ্লেষণ
এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর (বিএএফ) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট কর্পোরেশন কর্তৃক নির্মিত। এই বিমানটি সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ-২১ এর উপর ভিত্তি করে তৈরি চেংদু জে-৭ এর একটি উন্নত সংস্করণ।
বাংলাদেশের নির্দিষ্ট চাহিদা পূরণের জন্য এটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে এবং এটি এফ-৭ সিরিজের সবচেয়ে উন্নত মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়। এই নিবন্ধে আমরা এফ-৭ বিজিআই এর ইতিহাস, প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে এর ভূমিকা, উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানের ইতিহাস
এফ-৭ বিজিআই হলো চেংদু জে-৭ এর একটি উন্নত রূপ যা ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েত মিগ-২১ এর লাইসেন্সের অধীনে চীনে উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৬২ সালে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রযুক্তি হস্তান্তর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তবে সিনো-সোভিয়েত সম্পর্কের অবনতির কারণে নকশার তথ্য অসম্পূর্ণ ছিল। ফলস্বরূপ, চীনা প্রকৌশলীরা বিমানটি রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করে উন্নয়ন করেন। এফ-৭ বিজিআই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয় যা জে-৭জি মডেলের তুলনায় আরও উন্নত। ২০১১ সালে ১৬টি এফ-৭ বিজিআই বিমান ক্রয়ের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ২০১৩ সালে এগুলো সরবরাহ সম্পন্ন হয়। এই বিমানগুলো বাংলাদেশের পুরনো বিমানের বহরকে আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এফ-৭ বিজিআই প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য
এফ-৭ বিজিআই একটি একক ইঞ্জিনের হালকা ওজনের যুদ্ধবিমান যা ডেল্টা উইং ডিজাইনের জন্য পরিচিত। এর প্রধান প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
বৈশিষ্ট্য | বিবরণ |
---|---|
ইঞ্জিন | লিয়াং ওপেন-১৩এফ/ডব্লিউপি-৭ টার্বোজেট, ৮২ কেএন আফটারবার্নার থ্রাস্ট |
গতি | ম্যাক ২.২ (প্রায় ২,২০০ কিমি/ঘণ্টা) |
পরিসর | যুদ্ধ পরিসর: ৮৫০ কিমি, ফেরি পরিসর: ২,০০০ কিমি |
সার্ভিস সিলিং | ১৭,৫০০ মিটার (৫৭,৪২০ ফুট) |
ওজন | খালি ওজন: ৫,২৯২ কেজি, সর্বোচ্চ টেক-অফ ওজন: ৯,১০০ কেজি |
অ্যাভিওনিক্স | কেএলজে-৬এফ ফায়ার কন্ট্রোল রাডার (৮৬ কিমি পরিসর), তিনটি মাল্টি-ফাংশনাল ডিসপ্লে (এমএফডি), হটাস (হ্যান্ডস অন থ্রটল অ্যান্ড স্টিক) |
অস্ত্রশস্ত্র | পিএল-৫, পিএল-৭, সম্ভবত পিএল-৯ শর্ট-রেঞ্জ এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল; ৩,০০০ পাউন্ড পর্যন্ত বোমা এবং রকেট পড, লেজার-গাইডেড বোমা |
এই বিমানটি ডাবল ডেল্টা উইং ডিজাইনের সাথে আসে যা উচ্চ কোণে উড্ডয়নের সময় লিফট বাড়ায় এবং স্টলিং প্রতিরোধ করে। এটি একটি ফুল গ্লাস ককপিট দিয়ে সজ্জিত যা পাইলটের পরিস্থিতিগত সচেতনতা বাড়ায়।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে ভূমিকা
এফ-৭ বিজিআই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে প্রাথমিকভাবে ইন্টারসেপশনের জন্য ব্যবহৃত হয় তবে এটি মাল্টি-রোল ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়ায় আকাশ থেকে মাটিতে আক্রমণ এবং প্রশিক্ষণ মিশনেও ব্যবহৃত হয়। এটি থান্ডারক্যাট স্কোয়াড্রন দ্বারা পরিচালিত হয় এবং ঢাকার বাএএফ বেস বীর উত্তম এ.কে. খন্দকার থেকে পরিচালিত হয়। এই বিমানগুলো বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা এবং সীমান্ত নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এফ-৭ বিজিআই এর প্রশিক্ষণ সংস্করণ, এফটি-৭ বিজিআই, পাইলটদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা
২০২৫ সালের ২১ জুলাই ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে একটি এফটি-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে। এই দুর্ঘটনায় পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামসহ কমপক্ষে ২০ জন নিহত এবং ১৭১ জন আহত হয়। বিমানটি প্রশিক্ষণ মিশনে ছিল এবং যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনায় পড়ে বলে জানা গেছে। পাইলট জনবহুল এলাকা থেকে বিমানটি সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তবে দুর্ভাগ্যবশত এটি একটি দ্বিতল ভবনে আঘাত করে। এই ঘটনা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনাগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। তদন্ত চলমান রয়েছে এবং দুর্ঘটনার কারণ নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
F-7 BGI তুলনা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এফ-৭ বিজিআই একটি তৃতীয় প্রজন্মের যুদ্ধবিমান যা আধুনিক চতুর্থ বা পঞ্চম প্রজন্মের বিমানের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। তবে, এর কম খরচ এবং নির্ভরযোগ্যতা এটিকে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য উপযোগী করে তুলেছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বর্তমানে মিগ-২৯ এর মতো বিমানও পরিচালনা করে এবং ভবিষ্যতে আরও উন্নত বিমান অর্জনের পরিকল্পনা করছে। ২০২১ সালে, বাংলাদেশ সরকার ১৬টি পশ্চিমা মাল্টি-রোল যুদ্ধবিমান ক্রয়ের জন্য ২.৬ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ করেছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছে চীনের জেএফ-১৭ এবং জে-১০সি, রাশিয়ার মিগ-৩৫ এবং সু-৩৫ এবং পশ্চিমা বিমান যেমন ফ্রান্সের রাফাল এবং ইউরোফাইটার টাইফুন। এফ-৭ বিজিআই বর্তমানে একটি অন্তর্বর্তী সমাধান হিসেবে কাজ করছে, যতক্ষণ না এই নতুন বিমানগুলো বহরে যুক্ত হয়।
উপসংহার
এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে কাজ করছে যা আকাশ প্রতিরক্ষা এবং প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যদিও এটি একটি পুরনো নকশার উপর ভিত্তি করে তৈরি, তবুও এর আধুনিকীকৃত বৈশিষ্ট্য এটিকে কার্যকর করে তুলেছে। ২০২৫ সালের দুর্ঘটনা এই বিমানের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করলেও, এটি বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ভবিষ্যতে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী আরও উন্নত বিমান অর্জনের মাধ্যমে তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে তবে এফ-৭ বিজিআই এর অবদান উল্লেখযোগ্য থাকবে।
তথ্যসূত্র: